আমার সোনার বাংলায়, বৈষম্যের ঠাঁই নাই” এই স্লোগান নিয়েই শুরু হয়েছিল কোটা সংস্কার আন্দোলন। গত বছরের জুলাইয়ে যে আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল শিক্ষাঙ্গনের চৌহদ্দি পেরিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ে রাজপথে, গ্রামে-গঞ্জে, এবং একপর্যায়ে পরিণত হয় সরকার পতনের দাবিতে। ঠিক এক বছর আগে, গণ-অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটে।
পাঁচই অগাস্ট যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়, সেখানে জায়গা পান আন্দোলনের ছাত্রনেতারাও। তখন দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিল একটি বৈষম্যহীন, দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিতামূলক শাসনব্যবস্থার। কিন্তু আজ, এক বছর পর ফিরে তাকালে দেখা যায়-পরিবর্তনের সেই স্বপ্ন অনেকটাই ফিকে হয়ে গেছে।
পরিবর্তনের আশায় যে আন্দোলন, সেটাই কি এখন সুযোগের প্ল্যাটফর্ম?
বিশ্লেষকরা বলছেন, আন্দোলনের মূলকথা ছিল কোটা সংস্কার ও সমতা নিশ্চিত করা। কিন্তু ক্ষমতার পালাবদলের পর দেখা যাচ্ছে, সেই আন্দোলনের নেতাদের অনেকেই এখন প্রশাসনিক সুবিধা ভোগ করছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি থেকে শুরু করে চাকরি পর্যন্ত নানা ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করছেন।অভিযোগ রয়েছে, জুলাই মাসে যারা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের অনেকে এখন ‘মানিমেকিং মেশিন’-এ পরিণত হয়েছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করেই আবারো গড়ে উঠছে সুবিধাভোগীদের নতুন একটি চক্র।
কাঠামোগত সংস্কার কোথায়?
জনগণের একটি বড় অংশ মনে করেন, শুধু সরকার বদলালেই পরিবর্তন আসে না-আসতে হয় রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও নীতিগত সংস্কারের মধ্য দিয়ে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, দুর্নীতি, দলীয়করণ, প্রশাসনিক অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতার মতো পুরনো রোগগুলো এখনো বিদ্যমান। বরং কোথাও কোথাও তা আরও গভীর হয়েছে।বিশেষজ্ঞদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ হওয়া উচিত ছিল শক্তিশালী গণতান্ত্রিক কাঠামো গড়ে তোলা এবং সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডে এমন কোনো পদক্ষেপ দৃশ্যমান নয়।
পুরনো মুদ্রার উল্টো পিঠ?
বহুজন এখন প্রশ্ন তুলছেন-এই অভ্যুত্থান কি ছিল কেবল মুখ বদলের রাজনীতি? জনগণ কি নতুন আশার বদলে পেল পুরনো ব্যবস্থার পুনরাবৃত্তি?
ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও যে বৈষম্য ও দুর্নীতির সংস্কৃতি বহাল থেকেছে, তা থেকে প্রতীয়মান হয়, সমস্যাটা শুধুমাত্র ব্যক্তি নয়, গোটা ব্যবস্থাপনায়।
ভবিষ্যৎ কী?
এখনও সময় আছে। অন্তর্বর্তী সরকার যদি সত্যিকার অর্থে বৈষম্য দূর করতে চায়, তাহলে প্রয়োজন হবে জবাবদিহিমূলক প্রশাসন, স্বচ্ছ নিয়োগব্যবস্থা, এবং সর্বস্তরে দলীয় প্রভাবমুক্ত একটি কাঠামো প্রতিষ্ঠা।আন্দোলনের নাম করে কেউ যদি আবারও নতুন ক্ষমতাকেন্দ্র গড়ে তোলে, তবে তা ভবিষ্যতে আরও বড় সামাজিক বিভাজন তৈরি করবে।
শেষকথা:
একটি অভ্যুত্থান শুধু সরকারের পতন ঘটালেই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন হয় একটি নতুন রাজনৈতিক ও নৈতিক দর্শনের। এক বছর পর ফিরে তাকালে আমরা দেখতে পাই, ‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’এই স্লোগানটি আজও অনেকটাই স্লোগান হয়েই রয়ে গেছে। বাস্তবতার ভেলায় চেপে আবারও সেই পুরনো ব্যবস্থাই টিকে আছে, শুধু মুখগুলো বদলে গেছে।